প্রকাশ :
২৪খবরবিডি: 'বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ, মহামারি এবং যুদ্ধ চলছে। এ কারণে নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। দেশের প্রতিটি মানুষকে যার যার জায়গা থেকে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে।'
-গতকাল সকালে দেশের পাঁচ জেলায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মধ্যে ২৬ হাজার ২২৯টি ঘর এবং জমি হস্তান্তরকালে তিনি এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাঁচ জেলার সঙ্গে যুক্ত হন সরকারপ্রধান। এ সময় তিনি উপকারভোগীদের কাছে ঘরগুলো হস্তান্তরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের অনুমতি দেন। ঘর হস্তান্তরের মাধ্যমে পঞ্চগড় ও মাগুরা জেলার সব উপজেলাসহ দেশের ৫২টি উপজেলা ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দুর্যোগ ও সংকট আসার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সবাইকে সঞ্চয় বাড়াতে হবে। সেটা খাদ্য হোক বা জ্বালানি হোক।
-তিনি বলেন, লন্ডনে ১ লিটারের বেশি কেউ খাবারের তেল কিনতে পারে না। আর আমাদের এখানে তো এখনই ইচ্ছা করলে ৫ লিটার পর্যন্ত কিনতে পারছি। প্রত্যেকেই যেন আমরা ভাবী, আমাকে সাশ্রয় করতে হবে এবং আমাদের যতটুকু জমি আছে জায়গা আছে সেখানে উৎপাদন বাড়াতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ আমরা জানি আমাদের কী কী প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসতে পারে। তার জন্য নিজেদের সঞ্চয়ও করতে হবে, নিজস্ব সঞ্চয় আপনাদের রাখতে হবে। সেটা খাদ্য হোক, অর্থ হোক, যেভাবে হোক আপৎকালীন সময় যেন আপনার পরিবার কষ্ট না পায়, সেটা আপনারই ব্যবস্থা করতে হবে। আর আমরা সরকার সবসময় পাশে আছি, আমরা থাকব। নিজেদেরও ব্যবস্থা নিতে হবে, সেটাই আমি আপনাদের আহ্বান জানাই, সেটাই আপনারা করবেন এবং সতর্ক থাকবেন।
দলমত ভিন্ন হোক প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব আমার : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দলমত ভিন্ন থাকতে পারে, তাতে কিছু আসে-যায় না। আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তার মানে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব আমারই। তিনি বলেন, আমি আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বলব, তাদেরও দায়িত্ব আছে, অন্যান্য দলের যারা তাদেরও বলব, কারও কাছে যদি খবর থাকে যে বাংলাদেশের একটি মানুষ ভূমিহীন ও গৃহহীন আছে, অবশ্যই আমাদের খবর দেবেন। দলমত নির্বিশেষে যেই গৃহহীন থাকবে, আমরা তাদেরই ঘর করে দেব, তাদের ঠিকানা দেব, তাদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দেব।'
ঘর পাওয়া মানুষের হাসি জীবনের বড় প্রাপ্তি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, একটা ঘর একটা মানুষের জীবন পাল্টে দেয়। ঘর পাওয়া মানুষের মুখের সেই হাসিই জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া, এর চেয়ে বড় কিছু আর হতে পারে না। তিনি বলেন, আশ্রয়ণ একটি মানুষের ঠিকানা। যে বাংলাদেশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, সে বাংলাদেশের কোনো মানুষ যেন ঠিকানাবিহীন না থাকে, তাদের জীবনটা যেন অর্থহীন হয়ে না যায়, তাদের জীবনটা যেন সুন্দর হয়, সেই লক্ষ্য নিয়েই এই উদ্যোগ সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুই নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, সরকার সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্যই আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি ঋণ দেওয়া হচ্ছে এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তৃতীয়বার সরকার গঠনের পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, গৃহহীনদের সেমি-পাকা বাড়িঘর করে দেব। দুই কাঠা জমি সবার নামে কিনে দেব। এই জমি কেনার জন্য, কিছু জমি খাসজমি উদ্ধার করা, পাশাপাশি যেখানে খাসজমি পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে যেন জমি কিনে দেওয়া যায় তার জন্য একটি ফান্ড তৈরি করি।
-এরপর অনুভূতি ব্যক্ত করেন উপকারভোগী নাসিমা আকতার। বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমানের পরিচালনায় জলদস্যু জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা উপকারভোগী আবদুল হান্নান, ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক এনামুল হকের পরিচালনায় অনুভূতি ব্যক্ত করেন উপকারভোগী নাসিমা খাতুন ও জমিলা খাতুন। মাগুরার জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলমের পরিচালনায় জাঙ্গালিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে শাহীনুর বেগম, শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা সরকার, পঞ্চগড় সদরের মাহানা পাড়ার আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষাথী জান্নাত, রিকশাচালক রবিউল অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
যে ৫২ উপজেলা ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত হলো : ঢাকার নবাবগঞ্জ, মাদারীপুর সদর, শরীয়তপুরের ডামুড্যা, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, টাঙ্গাইলের গোপালপুর, মানিকগঞ্জের ঘিওর ও সাটুরিয়া, রাজবাড়ীর কালুখালী, ফরিদপুরের নগরকান্দা, নেত্রকোনার মদন। ময়মনসিংহের ভালুকা, নান্দাইল, ফুলপুর ও ফুলবাড়িয়া; জামালপুরের বক্শীগঞ্জ, দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী, নীলফামারীর ডিমলা, নওগাঁর রানীনগর, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি। রাজশাহীর মোহনপুর, চারঘাট ও বাঘা; বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও দুপচাঁচিয়া, নাটোরের বাগাতিপাড়া। চট্টগ্রামের পটিয়া, কর্ণফুলী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া; লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, রামগঞ্জ; ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, পাবনার ঈশ্বরদী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু, সাতক্ষীরার তালা, ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া এবং পটুয়াখালীর দশমিনা। মাগুরা ও পঞ্চগড় জেলার সবগুলো উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
উপকারভোগীরা যা বললেন : লক্ষ্মীপুরের রামগতির চর পোড়াগাছায় বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে আশ্রয়ণের জায়গা পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাম উদ্দিন জাতির পিতার স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। আমরা স্বাধীন দেশে ভূমিহীন ও গৃহহীন ছিলাম। জাতির পিতা ’৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চর পোড়াগাছা গ্রাম পরিদর্শন করেন। তিনি নিজ হাতে মাটি কেটে ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের জন্য জায়গা দেন। সেখানে জাতির পিতাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। জাতির পিতার দয়ায় আমরা আড়াই একর জায়গা পাই। সেখানেই খুব সুখে শান্তিতে বসবাস করছি। নাসিমা আক্তার বলেন, ভূমিহীন আমাকে জায়গা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী আপনি জায়গা দিয়েছেন। আমাদের মুখে এখন হাসি। আপনাকেও আমরা হাসিমুখে দেখতে চাই। বাগেরহাটের আবদুল হান্নান বলেন, আমাদের পরিবারে ৯ সদস্যের সংসার। সংসারের কথা বিবেচনা করে জলদস্যুতার জীবন বেছে নিই। খেয়ে না খেয়ে সুন্দরবনে দুঃসহ জীবন কাটিয়েছি। আপনার সাধারণ ক্ষমায় আমি সুন্দর জীবন পেয়েছি। এখন ঘর দিলেন। ময়মনসিংহের নাসিমা খাতুন বলেন, চার সন্তান রেখে স্বামী চলে যায়। এক সন্তানকে দত্তক দিই। অন্যের জমিতে থেকে সন্তানদের পড়ালেখা করিয়েছি। ঘর ছিল না। আপনি ঘর দিয়েছেন। জমিলা খাতুন বলেন, স্বামী আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিল। আপনি ঘর দেওয়ার পর স্বামী আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে হবে : প্রধানমন্ত্রী
-আমি এখন অনেক সুখী। বাগেরহাটের শাহীনুর বলেন, আগে ঘর ছিল না। এখন ঘর পেয়ে অনেক খুশি। পদ্মা সেতুর কারণে অনেক খুশি হয়েছি। কারণ আমার মায়ের বাড়ি নরসিংদী জেলায়। ২০২০ সালে মা যখন মারা যান, তখন মায়ের মুখ দেখতে পারিনি, কারণ ফেরি ৩ ঘণ্টা দেরি করেছিল। এখন বাপের বাড়ি যেতে আর ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না। শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা সরকার বলেন, বাবা একজন ভ্যানচালক। কোনো ঠিকানা ছিল না। এখন ঠিকানা পেয়েছি। পঞ্চগড়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষাথী জান্নাত বলে, বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই। আপনার ঘর দেওয়ার কারণেই এটা পারব। রিকশাচালক রবিউল বলেন, দীর্ঘদিন ঢাকায় রিকশা চালাতাম। বড় বড় দালান দেখে মনে মনে ভাবতাম, আমার কি একটা টিনের ঘরও হবে না? আপনি সে ব্যবস্থা করেছেন। এক মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, আরেক মা আপনি ঘর দিলেন।